ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শিক্ষা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় দপ্তর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালকসহ বেশ কয়েকটি পদে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বছরের পর বছর মাউশিতে কর্মরত ছিলেন—এমন অনেক কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে। এমনকি মাউশিতে যোগ দিয়ে যুগ পার করেছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। সরকারি চাকরিজীবীদের এক দপ্তরে একনাগাড়ে তিন বছরের বেশি থাকার বিধান না থাকলেও শিক্ষা প্রশাসনে সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। এ নিয়ে নানা কথাবার্তা হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি আমলে নেননি।
২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে নীতিমালা ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালা অনুযায়ী, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা একই দপ্তর বা সংস্থায় একনাগাড়ে তিন বছরের বেশি সময় থাকতে পারবেন না। শুধু তা-ই নয়, কোনো কর্মকর্তাকে একটি দপ্তর থেকে অন্য কোনো দপ্তর বা সংস্থায় বদলি করা যাবে না। মধ্যবর্তী সময়ে তাকে কলেজে ন্যূনতম দুই বছর চাকরি করতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, একজন কর্মকর্তা সমগ্র চাকরিজীবনে অনধিক তিনবার, তবে ছয় বছরের বেশি সময় কোনো দপ্তর বা সংস্থায় কর্মরত থাকতে পারবেন না। অবশ্য জরুরি প্রয়োজনে সরকার কোনো কর্মকর্তাকে যে কোনো সময় যে কোনো দপ্তরে বদলি করতে পারবে।
মাউশি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, অধিদপ্তরের একিউএইউ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা দিলরুবা আক্তার কর্মরত ১৮ বছর ধরে। ২০০৭ সালের ৭ মে তিনি মাউশিতে যোগদান করেন। সে সময় মইন উ আহমেদ-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের শাসনক্ষমতায় ছিল। এরপর আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও তিনি একই পদে বহাল।
একইভাবে সাধারণ প্রশাসন উইংয়ের শিক্ষা অফিসার (আইন) মো. আল আমিন সরকার ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে মাউশিতে কর্মরত। ২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি মাউশিতে যোগ দেন।
মোবাইল ফোনে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে দিলরুবা আক্তার কালবেলাকে বলেন, এটি সরকারি সিদ্ধান্ত, আমার ব্যক্তিগত কোনো ইচ্ছা নেই। এই বলে তিনি কল কেটে দেন। ২০০৮ সালে নিয়োগের কথা অস্বীকার করেন আল আমিন সরকার। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমি ২০১৫ সালে মাউশিতে যোগ দিয়েছি। এতদিন কীভাবে কর্মরত রয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, মাউশির আইন শাখায় দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া আমিও বারবার বদলি করার জন্য বলেছি।
শুধু দিলরুবা আক্তার বা আল আমিন সরকার নন, একিউএইউ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা মোছা. আয়শা সিদ্দিকা মৌসুমী ও মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের সহকারী পরিচালক লাইলুন নাহার এক যুগের বেশি সময় ধরে মাউশিতে কর্মরত। এর মধ্যে আয়শা সিদ্দিকা ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ও লাইলুন নাহার ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে এখানে কর্মরত।
জানতে চাইলে লাইলুন নাহার বলেন, বিগত সময়ে সরকার হয়তো বদলির প্রয়োজন মনে করেনি। সে কারণে এখানেই কয়েক বছর ধরে আছি। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিন্ন অন্যত্র পোস্টিংয়ের চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুতই হয়ে যাবে।
এ ছাড়া চার থেকে ১১ বছর মাউশিতে রয়েছেন আরও বিশের অধিক কর্মকর্তা। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা মো. ইউসুফ রহমান ও মোহাম্মদ আবুল হোসেন কায়েস প্রায় ১১ বছর এবং একিউএইউ শাখার সহকারী পরিচালক মাহমুদ হাসান সাড়ে ১০ বছর ধরে এখানে রয়েছেন। এদের মধ্যে মাহমুদ হাসান ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর যোগ দিয়ে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর যোগ দিয়ে এখনো রয়েছেন।
সাধারণ প্রশাসন উইংয়ের শিক্ষা কর্মকর্তা (ব্যক্তিগত নথি) হোসনে আরা ফেরদৌস প্রায় ৯ বছর, মাধ্যমিক উইংয়ের সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-সেসিপ) কাওছার আহমেদ ৯ বছর, প্রশিক্ষণ উইংয়ের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আকবর আলী সাড়ে ৮ বছর, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের সহকারী পরিচালক মিনহাজউদ্দীন আহম্মদ ৯ বছর, গবেষণা কর্মকর্তা মো. আজিম কবীর ৯ বছর, অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের সহকারী পরিচালক সেলীনা আক্তার ৯ বছর এবং মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের মনিটরিং অফিসার মো. রোকনুজ্জামান এখানে রয়েছেন ৯ বছরের বেশি।
এইচআরএম ইউনিটের সহকারী পরিচালক সুলতানা খান প্রায় ৮ বছর, প্রশিক্ষণ উইংয়ের সহকারী পরিচালক ড. নীহার পারভীন ৮ বছর, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের গবেষণা কর্মকর্তা কাজী তহুরা সাড়ে ৭ বছর, একিউএইউ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ৮ বছর, অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের সহকারী পরিচালক মোছা. মুর্শিদা খাতুন ৮ বছর, প্রকিউরমেন্ট অফিসার সুলতানা ইসরাত জাহান সাড়ে ৭ বছর, মাধ্যমিক উইংয়ের সহকারী পরিচালক মো. খালিদ সাইফুল্লাহ প্রায় ৭ বছর, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের গবেষণা কর্মকর্তা রিয়াদ আরাফাত প্রায় ৭ বছর এবং মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের মনিটরিং অফিসার মো. নজরুল ইসলাম এখানে কর্মরত আছেন সাড়ে ৬ বছর।
এ ছাড়া মাধ্যমিক উইংয়ের বিশেষ শিক্ষা শাখার উপপরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম প্রায় ৬ বছর মাউশিতে আছেন। আর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের সহকারী পরিচালক মো. শাহেদ শাহানের মাউশিতে যোগদানের তিন বছর হতে চলল। অন্যদিকে, এই উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. একিউএম শফিউল আজমও মাউশিতে যোগ দিয়েছেন সাড়ে ৪ বছর আগে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান কালবেলাকে বলেন, রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন সম্ভব নয়। অনেক ঝামেলা আছে।
আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল (সিআর) আবরারের মোবাইল ফোনে গত কয়েক সপ্তাহে একাধিকবার কল ও মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও তারা সাড়া দেননি।